‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ নির্মাণের সময় হুমায়ূন আহমেদ শুটিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন ডা. এজাজের হাতে। শিল্পীদের থাকা-খাওয়া, শুটিং স্পটের পরিবেশ, খাদ্যসরবরাহ থেকে শুরু করে সবকিছু তিনি নিখুঁতভাবে সামলাচ্ছিলেন। হুমায়ূন সবসময়ই তাঁর ঘনিষ্ঠদের ওপর নির্ভর করতেন, তবে তাঁর শিল্পসংবেদনশীলতা ছিল আপসহীন। কোনো বিচ্যুতি তিনি মেনে নিতে পারতেন না।
একদিন শুটিংয়ের সময় খাবার পরিবেশন চলাকালে এক অভিনেতা অভিযোগ করেন, খাবারে তেল বেশি থাকায় তাঁর পেট খারাপ হয়েছে। পাশে থাকা হুমায়ূন আহমেদ এই মন্তব্য শুনে ক্ষুব্ধ হন। বাবুর্চিকে ডেকে তিনি জানতে চান, তরকারিতে তেল বেশি হলো কেন। বাবুর্চি জানান, মাছটা নদীর পাঙাশ, তাই তেল বেশি হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে হুমায়ূন রাগের মুখে ডা. এজাজকে ধমক দিয়ে বলেন, “সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এখান থেকে চলে যান।”
এই ঘটনায় ডা. এজাজ হতভম্ব হয়ে যান। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা ও কাজের সম্পর্ক যেন মুহূর্তে মুছে যায়। তিনি নিরবে দায়িত্ব হস্তান্তর করে অপমানিত বোধ করে চলে যান। পরে তিনি হুমায়ূনের সহকারী পরিচালক শামীমা নাজনীনের কাছে নিজের কষ্ট ও অভিমান ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “শিল্পীর পেট খারাপের পেছনে খাবারের দায় কম, তিনি আগেই জাঙ্কফুড খেয়েছিলেন। অন্য কেউ তো অভিযোগ করেনি। তবু আমি অপদস্থ হলাম।” শামীমা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তিনি হুমায়ূনের সঙ্গে কথা বলবেন।
কিছুদিন পর হুমায়ূন আহমেদ একটি টেলিফিল্মে অভিনয়ের জন্য ডা. এজাজকে ডাকেন। প্রথমে সন্দিহান থাকলেও শামীমার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে তিনি শুটিংয়ে যোগ দেন। প্রথম দুই দিন হুমায়ূন তাঁর সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু তৃতীয় দিন তিনি সবাইকে ডেকে পাঠান। সেখানে হুমায়ূন আহমেদ ডা. এজাজের দিকে তাকিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “দেখো ডাক্তার, তোমাকে আমি এত স্নেহ করি, তুমি এতদিনেও তা বুঝনি। আমি তোমাকে বেশি বকি, কারণ তোমার ওপর আমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। শিল্পীর খাবার নিয়ে মন্তব্য আমাকে কষ্ট দিয়েছিল। রাগে তোমার ওপর ঝাল ঝেড়েছিলাম। তুমি সত্যি চলে গেলে? আমাকে কী চিনলে?”
এই কথাগুলো ডা. এজাজের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কাটে। তিনি দেখেন, হুমায়ূন আহমেদের চোখে জল। তিনি এজাজকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। ডা. এজাজ পরে লিখেছেন, “প্রথমে বুঝিনি, আমার চুল ভিজে যাচ্ছে কেন। ভাবলাম বৃষ্টি নামল কি না। পরে বুঝলাম, হুমায়ূন স্যারের চোখের জল। তিনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে কাঁদছিলেন।”
এই কান্না ছিল শুধু অভিমানের নয়, এতে মিশে ছিল বন্ধুকে হারানোর ভয়, আবেগের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার অনুশোচনা এবং অপরিসীম স্নেহ। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এমনই এক শিল্পী—যিনি শিল্পে আপসহীন, সংবেদনশীলতায় অসাধারণ এবং নিজের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
১৯ জুলাই, তাঁর মৃত্যুদিবসে এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁর জীবনদর্শন—যেখানে স্নেহ, জেদ, কষ্ট আর ভালোবাসার এক অপূর্ব মিশ্রণ ছিল। তাঁর এই কান্না শ্রাবণের মেঘের মতো নিঃশব্দে হৃদয় ভিজিয়ে চিরকালীন স্মৃতি হয়ে থাকবে।